আমরা রাবাতের যে হোস্টেলে থাকি এখানে একশরও বেশী দেশের ২০০০ স্টুডেন্টস একসাথে বাস করি । আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির ওয়াসিম একদিন আমাদেরকে ( আমি আর আমার বাংলাদেশী রুমমেট শুয়াইব ) বলল যে কানাডিয়ান একটা সিরিজের দুবাই এয়ারপোর্টের একটা সিন শুট করার জন্য কিছু বাংলাদেশী , ইন্ডিয়ান ফেইস দরকার , আমরা দুইজন যাবো কিনা ? আমাদের দুইজনের পরীক্ষা পরের সপ্তাহে কিন্তু সিনামায় তাও আবার যেনতেন সিনামা না কানাডিয়ান সিনামায় মুখ দেখানোর এমন সুযোগ নষ্ট করলাম না । পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও বলে দিলাম যে যাবো আমরা । দুবাইএর এই সিনটা ওরা শুট করবে মরক্কোর হলিউড খ্যাত সুবিখ্যাত (Ouarzazzate) ওয়ারযাযাত শহরে । আসলে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার কারণে নাই বলে দিয়েছিলাম অলরেডি কিন্তু ওয়ারযাযাত শোনার পর আর নাতে থাকতে পারলাম না । কি আছে এই ওয়ারযাযাত শহরে ?
বহু বিখ্যাত হলিউড , জার্মান , ইতালিয়ান , ফ্রেঞ্চ মুভির শুটিং হয়েছে এই শহরে । মরক্কোর দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের খুব বড়ও না আবার খুব ছোটও না এমন একটি শহর ওয়ারযাযাত যার তিনদিকেই সাহারা মরুভূমি এবং অন্য দিকে মরক্কোর বিখ্যাত অ্যাটলাস পর্বতের শহর মারাক্কেশ । তো আমরা রাজি হয়ে গেলাম । এবার সমস্যা হিসেবে দেখা গেল যে যেদিন শুটিং তার পরের দিনই আমাদের পরীক্ষা কিন্তু আমাদের পাকিস্তানী ইভেন্ট ম্যানেজার আমাদের কে আশ্বস্ত করলেন যে আমরা বৃহস্পতিবার রাতে ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে রওনা দিব এবং শুক্রবার দিন সকাল বেলা গন্তেব্য পৌঁছব তারপর শনিবার দিন সারাদিন শুট সন্ধায় আমরা আবার রওনা করবো এবং রবিবার দুপুরের আগেই আবার রাবাতে ফেরত আসতে পারবো । আমাদের পরীক্ষা সোমবারে তাই ফাইনালি রাজি হয়ে গেলাম ।
রোযার মাস ছিল ইফতার করে আমরা ৪ জন আমি, আমার রুমমেট শুয়াইব আর পাকিস্তানী বন্ধু-ভাই ওয়াসিম এবং আরেক পাকিস্তানী ছোটভাই রোমান খান আমাদের হোস্টেল থেকে রওনা দিলাম রাবাত , আগদাল ট্রেন ষ্টেশনের জন্য । মরক্কোতে এক ট্যাক্সিতে তিনজন একসাথে উঠা যায় এর বেশী না কিন্তু আমারা ৪ জন মাশাল্লাহ যে সাইজ ৪ জনই এক ট্যাক্সিতে যেতে পারবো, আমরা যারা ভারতীয় মহাদেশের আছি হয়তো চিন্তা করতাম আরেহ বিশ টাকা বাড়ায়া দিমুনে ৪ জনই উঠেন এক ট্যাক্সিতে কিন্তু মরক্কোতে তে এটা প্রায় অসম্ভব তাই আমরাও নিয়ম অনুযায়ী ২ টা ট্যাক্সি নিয়ে আগদাল ট্রেন ষ্টেশনে নামলাম । আগেরবার যখন এই ষ্টেশনে এসেছিলাম আর বর্তমান যে চিত্র তা কোনভাবেই এক নয় । এ যেন এক নতুন ষ্টেশন । নতুন করে মরক্কোতে বুলেট ট্রেন অন্তর্ভুক্ত করায় তারা আগের ষ্টেশনগুলোকে একদম নতুন রুপ দিয়েছে । যাইহোক আমাদের এতো তাড়াহুড়ো নেই যে বুলেট ট্রেন নিতে হবে আবার নতুন সংযুক্ত হওয়ায় বুলেট ট্রেন এর টিকেটের দামটাও আমাদের নাগালের বাইরে , আমরা নরমাল স্পীড ট্রেনেরই ৪ টা টিকেট কিনলাম ক্যাসাব্লাঙ্কার গন্তেব্য । অন্যরা শুধুমাত্র একটা করে ট্রাভেল ব্যাকপ্যাক নিলেও আমি নিয়েছিলাম একটা মাঝারী আকৃতির সুটকেস । সুটকেস টানতে টানতেই ট্রেনে উঠলাম । সুন্দর সাজানো গুছানো ট্রেন, আমাদের বাংলাদেশের ট্রেন এর মত মানুষ এখানে ফ্যান , লাইট এগুলোকে নিজের সম্পত্তি মনে করে আরও নিবিড় পরিচর্চা করার জন্য বাড়িতে নিয়ে যায় না ।
আবার ট্রেনে চেকার আসলে কেও দৌড় দিয়া টয়লেটে যায় না, গেলেও ধরা খাওয়াই লাগে । ধরা খেলে তো কোন মাফ নেই ৫০ দিরহামের কারচুপির জন্য ৫০০ দিরহাম জরিমানা । যাইহোক আমরা এক ঘণ্টায় ক্যাসাব্লাকার ক্যাসাপোর্টে এসে নামি তখন ঘড়িতে বাজে রাত ৯ টা। চারজনের মধ্যে আমরা ৩ জনই স্মোকার তাই আগেই এক প্যাকেট মারলবোরো কিনে রেখেছিলাম । ষ্টেশনের বাইরে এসেই তিনজন তিনটা সিগারেট ধরালাম । ক্যাসাব্লাঙ্কা আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ এবং ব্যস্ততম শহর একিসাথে এটি মরক্কোর বাণিজ্যিক রাজধানীও বটে । ট্রেন ষ্টেশন থেকে অল্প দূরেই বিখ্যাত হাসান মসজিদ যেটি আফ্রিকার সর্ববৃহৎ এবং সারা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মসজিদ । কিন্তু আমাদের কে রিসিভ করার জন্য বাকি আর যারা আমাদের সাথে শুটিঙের জন্য যাবে তারা যেকোনো সময় এসে পরতে পারে এই জন্য আমরা ষ্টেশনের সামনেই দাড়িয়ে-বসে থাকলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটি মিনি বাস আসলো , বাসে উঠে দেখি ক্যামেরা টেমেরা কিছু নাই; ২ জন আফগানি স্টুডেন্ট যারা আমাদের পূর্ব পরিচিত, আছেন ২জন চাচার বয়সী পাকিস্তানী , ২ জন আমাদের বয়সী বা আমাদের থেকে অল্প সিনিয়র পাকিস্তানী আর ড্রাইভারসহ মোট ১১ জন । তো আমাদের এজেন্ট উনি বললেন যে আমরা এখন ওয়ারযাযাতের জন্য যাত্রা করবো কারো যদি কোন পানি বা অন্য কিছু কেনা লাগে তাহলে যেন এখনই কিনে ফেলি কারন মারাক্কেশের আগে আমরা আর থামছিনা কোথাও । যাইহোক, অবশেষে রাত ১০ টায় আমরা যাত্রা শুরু করি । বাসে সবগুলো সীটে সবাই বসার পর পেছনের পুরো চারটি সীট খালি ছিল , আমার জন্য ভালোই হল , আমি শুরুতেই প্রায় ২ ঘণ্টার একটা ন্যাপ নিয়ে নিলাম ।
আমাদের মিনিবাস তখন অলরেডি কোথায় আছে জানি না কিন্তু যেদিকে তাকাই শুধু দেখি বড় বড় পাহাড় আর অসীম প্রান্তর । ফোনে ফেইসবুক , ফুটবলের খবরাখবর নেয়া সহ অন্যান্য সামাজিক একটিভিটি (?) করে কাটালাম পরবর্তী ৩-৪ ঘণ্টা । দেখলাম ওয়াসিম গভীর ঘুমে মগ্ন যে কিনা বলেছিল যে সে নাকি জার্নিতে ঘুমাইতে পারে না । ভোররাত ৩টার দিকে আমরা মারাক্কেশে একটি ছোট রেস্টুরেন্টের সামনে যাত্রা বিরতি করি । আমরা ৩ জন (একি ৩ জন যারা স্মোকার) বাদে সবাই রোযা রাখবে তাই সেহ্রির জন্য থামতে হল । আমরা মোট এগারজন মিলে নিলাম ৪ টা মুরগির তাজিন । তাজিন মরোক্কান প্রসিদ্ধ ডেলিক্যাসি । একটা বাটির মধ্যে চিকেন অথবা বিফ বা ফিশ এর সাথে চৌদ্দ রকমের ভেজিটেবল স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাজাদের মুকুটের মত তাজ বা টুপি পরিয়ে স্টিম এর মাধ্যমে এই তাজিন রান্না করা হয় । স্পেশালি, মারাক্কেশের তাজিন মরক্কোজুড়ে বিখ্যাত । আমরা আরও নিলাম কয়েক বাটি আদাস যেটি আমাদের দেশের ডালের মত কিন্তু একটু আলাদা । মরোক্কানরা ইন্ডিয়াকে খুব ভালবাসে তাই আমাদের ইন্ডিয়ান ফেইস গুলা দেখে হোটেলওয়ালা আরও ২-১ টা আইটেম বিনা মুল্যেই দিয়ে দিলো । আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করে হোটেলের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম । হঠাৎ দেখি এক পাকিস্তানী চাচাও ঐ একি দিকে আসতেছে, ভাবলাম সম্মান দেখাইয়া কি সিগারেটটা ফেলে দিবো কিনা কিন্তু যখন চিন্তা করলাম যে এনাদের সাথে বাকি ২ দিন ২ রাত থাকতে হবে তখন ভাবলাম লুকোচুরি করে লাভ নাই । উনিও সরাসরি আমার কাছে এসে আমার কাছে লাইটার চাইলেন সিগারেট ধরানোর জন্য , আমি লাইটার দিয়ে স্বস্তি পেলাম যাক বাবা, চাচাই হউক আর দাদাই হউক আমরা স্মোকার, আমরা সবাই একদল ।
যাইহোক অবশেষে সবার পান সিগারেট , বাথরুমের পর্ব শেষ করে আমরা আবার রওনা দিলাম । ফোনে পিঙ্ক ফ্লয়েডের “শাইন অন ইউর ক্রেইজি ডাইমন্ড” গানটা ছিল । একি গান রিপিট করে শুনলাম কয়েকবার এরি মধ্যে প্রায় ফজরের সময় হয়ে গেলো । আমরা এক ছোট পাহারি ঢালের উপর থামলাম । কেও কেও নামাজ পরে নিল আর আমি আমার জানালার পাশে বসে দেখলাম চারদিকে পাহাড় পর্বত বেষ্টিত এই শহরে রাতের আঁধার কেটে সকাল হবার মনোরম দৃশ্য ।
যে দৃশ্য আমার মন থেকে এখনো মুছে যায়নি কোনদিন যাবে কিনা আমি জানি না কিন্তু আমি চাইনা এই দৃশ্য ভুলতে এ যেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য । আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম । সকাল হয়ে যাওয়ায় এখন দুপাশের প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখে শুধু মুগ্ধই হলাম । আমারা অ্যাটলাস পর্বতের সবচেয়ে উঁচু রেঞ্জ এর মধ্য দিয়েই যেতে লাগলাম । হাজার বাঁক , শত টার্ন পেড়িয়ে আমাদের বাস ছুটছে ৬০-৭০ কি মি বেগে । এই দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় নতুন ড্রাইভার না নিয়ে যাওয়াই ভালো । ভাগ্যবশত আমাদের ড্রাইভার খুবি অভিজ্ঞ এবং স্পেশালি এই রোডের মাস্টার বলা চলে । অ্যাটলাসে কোন কোন সময় আমি হয়তো একটা অনেক উঁচু পাহাড় দেখলাম আর আমার সামনে বসা ওয়াসিমকে বললাম যে দেখো ব্র প্রকিতির কি লীলাখেলা, কত উঁচা পাহাড় ; ১০ মিনিট পরে দেখি যে আমরা ঐ পাহাড়ের উপরে । কি যে সেই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না । মরক্কোতে তখন গ্রীষ্মকাল হলেও চার হাজার মিটার চূড়ার সাদা বরফগুল দৃশ্যমান, কোন স্থানে চূড়ার বরফ গলে নদীর মত সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও ছোট এক পাহারে দেখলাম এক মধ্যবয়সী পাহাড়ি মহিলা গাধার পিঠে চড়ে ঐ পাহাড়ি রাস্তা ভেঙ্গে কোন অজানা উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে । দেখলাম মহিলারাই খেতে খামারে কাজ করছে। ৪ ঘণ্টার মনোরম দৃশ্য দেখার পর সকাল ১০ টায় আমরা ওয়ারযাযাতে পৌঁছলাম । লম্বা জার্নিতে সবাই ক্লান্ত তাই আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল অ্যামস্টারডামে চেক-ইন করেই দিলাম এক ঘুম ।
চলবে …। ( এটা আমার প্রথম লেখা যদি আপনারা বলেন তবে আমি বাকিটা পোস্ট করবো । কিভাবে কি শুটিং করলাম , কি মুভি ইত্যাদি ইত্যাদি । এছাড়া বিখ্যাত চলচিত্র মিউজিয়াম ভ্রমনের অভিজ্ঞতা , গেইম অফ থ্রন্সের মিরীন ভ্রমনসহ রাবাতে ফেরত আসা এবং আমার লাগেজ হারানোর মধুর বিড়ম্বনা )
মরক্কো আমাদের মতোই একটি উন্নয়নশীল দেশ হলেয় এখানে রাস্তাঘাট অনেক পরিস্কার স্পেশালি , টুরিস্টিক প্লেইস গুলো । আপনারাও যেখানেই যান ময়লা আবর্জনা যথাস্থানে ফেলবেন যাতে করে আমরা আমাদের বিশ্বকে দূষণমুক্ত রাখতে পারি ।
Leave a Reply