করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ঘন ঘন ভূমিকম্প সিলেটে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ডেঞ্জার জোন হিসেবে চিহ্নিত সিলেটে পাঁচ মাসে ৫ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। নিকট অতীতে এমনটি হয়নি। সর্বশেষ ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়- যা ভাবিয়ে তুলছে লোকজনকে। ২১ জুন বিকাল ৪টা ৪৮ মিনিটে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে ২২ জুন ভোর ৪টা ২২ মিনিটে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
দুটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল ভারতের মণিপুর রাজ্যে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউএস-জিএস জানিয়েছে, এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল মিজোরামে দারলোয়ানের ভূমির ৪০ কিলোমিটার গভীরে। গত কয়েক দিনে মিজোরাম-মণিপুর এলাকায় কয়েক দফা ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
সিলেটে এর আগে ২৫ মে রাত ৮টা ৪২ মিনিটে ৫.১ মাত্রার, ১৪ এপ্রিল রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে ৩.৬ মাত্রার এবং ২৭ জানুয়ারি বেলা ১টা ১২ মিনিটে ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড়ো মাত্রার ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ। তাই এ নিয়ে সিলেটের লোকজনের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের জন্য ডেঞ্জার জোন (বিপজ্জনক এলাকা) সিলেট। সিলেট থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ডাউকি ফল্টের (ফল্ট হচ্ছে ভূগর্ভস্থ প্লেটের ফাঁক) অবস্থান। অন্যদিকে শাহবাজপুর ফল্টও (হবিগঞ্জ-কুমিল্লা এলাকাধীন) সিলেটের কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুবই বেশি। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের তিনটি বলয় বা জোন চিহ্নিত করা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত। সিলেট উত্তর-পূর্বাঞ্চল জোনে থাকায় এখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
প্রায় পৌনে ৫০০ বছর আগে ১৫৪৮ সালে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ভূ-আকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই সময় উঁচু-নিচু ভূমি পরিণত হয় সমতল ভূমিতে। পরবর্তীতে ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ এবং ১৮৬৯ সালে হওয়া ভূমিকম্প সিলেটের ভূ-মানচিত্র পাল্টে দেয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকালে সিলেটে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, সেটি ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে পরিচিত। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৭! ভয়াবহ সেই ভূমিকম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের ৫ শতাধিক ভবন ভেঙে পড়ে। মানুষও মারা যায় অনেক। ওই ভূকম্পই সিলেটজুড়ে বিশালাকারের হাওর, বিল ও জলাশয়ের সৃষ্টি হয়। গত শতাব্দিতে সিলেট অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই হয়েছিল ভূমিকম্পটি।
এ শতাব্দিতে এখনও বড় মাত্রার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চলে হয়নি। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটতে পারে। সিলেটে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভয়ানক ভূমিকম্পের পর পেরিয়ে গেছে ১২৩ বছর। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ১৯৯৮ সালে যে জরিপ চালায় সে জরিপে বলা হয়, সিলেট অঞ্চল ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় ভূকম্পন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে ঘন ঘন ভূ-কম্পন হচ্ছে। গেল প্রায় ৫ মাস সময়ের মধ্যে সিলেটে ৫টি ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানান, সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বিভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনারে উল্লেখ করেন, ‘ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ডাউকি থেকে সিলেট মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে। ডাউকি পয়েন্টে যদি ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে সিলেটে হবে ৫ মাত্রার মতো। সরাসরি সিলেটে যদি ৫ থেকে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে ক্ষতি হবে ১০-২০ ভাগ। এর বেশি মাত্রার হলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে।’
Leave a Reply